Ticker

6/recent/ticker-posts

পরকাল দর্শন- পরকাল বলে কিছু আছে কি? ( পর্ব ১)


পরকাল-কি-আছে

পরকাল দর্শন- পরকাল বলে কিছু আছে কি?

পরকাল বলতে সাধারণত মৃত্যু পরবর্তী জীবনকেই বুঝায়। পরকাল আছে কি নেই - এ প্রশ্নটি মানব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন। এক শ্রেণীর মানুষ মনে করে পরকাল বলতে আসলে কিছু নেই। মৃত্যু মানে মানবজীবনের শেষ। মৃত্যুর পর পরবর্তী জীবন বলতে আর কিছু থাকতে পারে না। যেহেতু পরকালীন জীবনের কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের কাছে নেই তাই এ জীবনের ধারণা সঠিক নয়। এটি শুধুই মনের ধারণা মাত্র। বাস্তব নয়।

আরও এক শ্রেণীর মানুষ পৃথিবীতে আছেন যারা মনে করেন যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে না। মৃত্যুর পর মানুষ পুনরায় জীবন লাভ করবে এবং সেই জীবনে এই জাগতিক জীবনের সমস্ত কৃতকর্মের হিসাব তাকে দিতে হবে। ভাল কাজের পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য তাকে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।

পরকাল আছে কি নেই - এই প্রশ্নের আলোকে আমরা সাধারণভাবে মানব জাতিকে এই দুইভাগে বিভক্ত অবস্থায় পাই। উভয় পক্ষেই জনমত রয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল দুই পক্ষের ধারণা পরস্পর বিরোধী। তাই দুই পক্ষের ধারণা যে যুগপৎভাবে সত্য হওয়া সম্ভব নয় তাই যৌক্তিক। পরকাল হয় থাকবে,না হয় থাকবে না - দুইটির একটিই হবে। সুতরাং দুইটি ধারণার মধ্যে একটি সত্য হলে অন্যটি অসত্য বা মিথ্যা হতে বাধ্য। আমি এই দুইটি ধারণার কোনটির সত্যতা কিংবা অসত্যতা প্রতিষ্ঠার দিকে যাব না। আমার এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হল এই দুটি ধারণার স্বরূপ বিশ্লেষণ করা।

প্রথমত যারা পরকালে অবিশ্বাসী তাদের ধারণাটিকে আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। আমি মনে করি যারা পরকালে অবিশ্বাস করেন তাদের এই ধারণাটি স্বাভাবিক চিন্তাপ্রসূত নয়। এটি কোন নিরাপদ ধারণাও নয় বরং ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক ধারণা । ‘সাবধানতা’ এই ধারণাটিকে অনুমোদন করে না। আমি এই প্রসঙ্গে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করতে চেষ্টা করব -

প্রথমত

এই ধারণাটি ন্যায়ের দাবীর পরিপন্থী বা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। কারণ, যদি পরকাল বলে কিছু না থাকে এবং মানুষকে তার কৃতকর্মের কোন হিসাব দিতে না হয় তাহলে এই পৃথিবীর বড় বড় সব অপরাধীরা শাস্তি না পেয়ে বেঁচে যাবে। তাদের শাস্তি পাওয়ার আর কোন সুযোগই থাকবেনা। অথচ ন্যায়ের দাবী হচ্ছে তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কোন অপরাধীরই শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া উচিত নয়। অপরাধী শাস্তি পাবে এবং সব অপরাধী তাদের অপরাধের সমপরিমান শাস্তি পাবে এটাই ন্যায়ের দাবী। কিন্তু আমরা এই পৃথিবীতে সব অপরাধীকে শাস্তি পেতে দেখি না। কিছু অসহায় নিরীহ অপরাধী শাস্তি পেলেও বড় বড় অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। তাদের আইনের অওতায় আনা যাচ্ছে না। অর্থাৎ নৈতিকতার এই দাবী পূরণ হচ্ছে না। এভাবে চললে নৈতিকতা হয়ে পড়ে প্রহসনের বিষয়। নৈতিক দাবী পূর্ণতা লাভ করে না। নৈতিকতার মর্যাদাও অক্ষুন্ন থাকে না। 

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে তাহলে নৈতিকতার মর্যাদাকে কি ভাবে অক্ষুন্ন রাখা যায় ? এই প্রশ্নের উত্তরে নেহাত জড়বাদী নীতিবিজ্ঞানীরাও পরকালের অস্তিত্বকে টেনে এনেছেন। তাদের মত হচ্ছে মানব জীবনের নৈতিক দাবীগুলি পরিপুর্ণভাবে পুরণ করতে হলে সকলের অধিকারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে অর্থাৎ নৈতিকতার মর্যাদাকে পূর্ণতা দান করতে হলে মানবজীবনে পরকাল নামক একটি অধ্যায়ের প্রয়োজন আছে। 

বহুব্রীহি-অনলাইন-কোর্স
বহুব্রীহি অনলাইন কোর্স

শুধু পরকাল থাকলেই চলবে না, পরকালের আদালতে দাঁড় করানোর জন্য অপরাধীদেরও বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে অর্থাৎ আত্মার অমরত্বেরও প্রয়োজন আছে। আবার সেই দিনের সেই বিচারকার্যটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী সূক্ষ্মজ্ঞানী এক শক্তিশালী সত্তারও প্রয়োজন আছে। নীতিবিজ্ঞানীগন এই তিনটি বিষয়ের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। আবার এই তিনটি বিষয়ের পূর্বে আরও একটি বিষয়কে স্বীকার করতেই হবে। সেটা হল ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’। সুতরাং ইচ্ছার স্বাধীনতা, পরকালীন জীবন, আত্মার অমরত্ব, এবং মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব -- এই চারটি বিষয়কে নীতিবিজ্ঞানীগণ নৈতিকতার স্বীকার্য সত্য হিসাবে গ্রহন করেন।

এবার মূল কথায় আসা যাক। প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, যারা পরকালের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন তাদের চিন্তা বা ধারণাটি নৈতিকতার এই দাবীর পরিপন্থী এবং প্রয়োজনের দাবীর ও পরিপন্থী। ‘যা হওয়া উচিত এবং প্রয়োজন তা হবে অথবা অন্তত হওয়ার সম্ভাবনা আছে’- এরূপ চিন্তাই স্বাভাবিক চিন্তা। এর বিপরীত চিন্তা করাটা চিন্তার ক্ষেত্রেও একটি স্থুল এবং অস্বাভাবিক চিন্তা। এখানে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, যারা পরকালকে অস্বীকার করেন তারা কিন্তু পরকালের ঔচিত্য এবং প্রয়োজনীয়তা কোনটাকেই অস্বীকার করতে পারেন না। 

Home-devices
Smart Home Devices from BD-Shop

তাদের কেউ যদি কোন কারণে কারো দ্বারা অত্যাচারিত বা নির্যাতিত হয়ে থাকেন এবং ন্যায় বিচার থেকেও বঞ্চিত হয়ে থাকেন তখন অপরাধীর ‘কোন না কোন ভাবে বিচার হউক’ এটাই কামনা করেন। আর ‘কোন না কোন ভাবে বিচার হউক’ এ কামনার মধ্যেই পরকালের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি নিহিত। এটি একটি স্বাভাবিক কামনা। এরূপ ক্ষেত্রে সব মানুষই সাধারণত এভাবেই কামনা করে। কারণ কোন মানুষই ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হতে চান না। ন্যায় বিচার প্রাপ্তি মানুষের একটি স্বাভাবিক মৌলিক অধিকার। অথচ পরকালে অবিশ্বাসীদের চিন্তা বা ধারণাটি হচ্ছে ‘যা হওয়া উচিত, প্রয়োজন এবং কাম্য অথচ তা হবে না’- এরূপ। এ ধারণাটি ন্যায়ের দাবী, প্রয়োজনের দাবী ও মনের স্বাভাবিক কামনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

দ্বিতীয়ত 

মহান স্রষ্টা মানুষকে দায়িত্বশীল প্রাণী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। দায়িত্ব, কর্তব্য, ঔচিত্য, অনৌচিত্য, ভাল, মন্দ প্রভৃতি বিশেষণগুলি আমরা সধারণত মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকি। এ কথার অর্থ হচ্ছে আমরা মানুষকে সৃষ্টিগতভাবেই দায়িত্বশীল প্রাণী বলে মনে করি। মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মত নয়। এখন মানুষ যদি সৃষ্টিগতভাবেই দায়িত্বশীল ও চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে থাকে তাহলে স্রষ্টানিজেই তার উপর দায়িত্ব অর্পন করবেন এটাই স্বাভাবিক। স্রষ্টা মানুষকে দায়িত্বশীল প্রাণী হিসাবে সৃষ্টি করলেন অথচ কোন দায়িত্ব দিলেন না -- এটা হতে পারে না। কারণ তিনি কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করেন না। 

কাজেই মানুষ দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এবং দায়িত্ব সহ সৃষ্ট হয়েছেন এটাই স্বাভাবিক চিন্তা। আর দায়িত্ব যদি থাকে তাহলে জবাবদিহিতাও থাকবে। দায়িত্ব আছে অথচ জবাবদিহিতা নেই এরূপ কখনো হতে পারে না। সুতরাং ইহকালীন জীবনের পুরোটাই হচ্ছে দায়িত্ব পালনের জীবন আর পরকালীন জীবনের পুরোটাই হচ্ছে জবাবদিহিতা ও ফলাফল ভোগের জীবন। অর্থাৎ পরকালীন জীবনের যৌক্তিকতা ও অনিবার্যতাই এখানে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়। কাজেই পরকালীন জীবনে অবিশ্বসীদের ধারণাটা মানবসৃষ্টি তত্ত্বের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে আমার মনে হয়।

Bohubrihi-Online-Course
Bohubrihi Online Course


তৃতীয়ত 

আলোচনার শুরুতেই আমি বলেছিলাম পরকালে অবিশ্বাসীদের ধারণাটি একটি অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ধারণা।

পরকালে অবিশ্বাসীদের ধারণা যদি সত্য হয় অর্থাৎ পরকাল বলতে কিছু না থাকে তাহলে যা হবে তা হল: 

  • ভিক্টিমরা (অর্থাৎ নির্যাতিতরা) কখনও বিচার পাবে না তারা ন্যায় বিচার থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবে। অথচ যাহ হওয়া মোটেও উচিত নয়।
  • অপরাধীরা চিরতরে বেঁচে যাবে। তারা আর কখনও তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি পাবে না। অথচ যা হওয়াউচিত নয়। শাস্তি হল অপরাধীর নেতিবাচক পুরস্কার। শাস্তি পাওয়া অপরাধীর অধিকার।
  • পরকাল না থাকলে কাউকে ইহকালীন জীবনের কাজের হিসাব দিতে হবে না। থাকবে না কোন জবাবদিহিতা।
পরকালে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী সবাই একসাথে বেঁচে যাবে। কারো হারানোর কিছু থাকবে না।


কিন্তু যদি পরকালে অবিশ্বাসীদের ধারণাটি সত্য না হয়ে বিশ্বাসীদের ধারণাটি সত্য হয় তাহলে যা হবে তা হলো: 

  • ভিক্টিমরা যথোচিত ন্যায় বিচার পাবে। তারা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না এবং ন্যায়ের দাবী পূরণ হবে।
  • অপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি পাবে এবং কোন অবস্থাতেই বাঁচতে পারবে না। ফলে এ ক্ষেত্রেও ন্যায়ের দাবী পূরণ হবে।
  • পরকালে বিশ্বাসীরা যেহেতু কৃতকর্মের হিসাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং পরকালের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল

তাই তারা হিসাব দিয়ে মুক্তি পেয়ে যাবে। কিন্তু পরকালে অবিশ্বাসীরা যেহেতু এ বিষয়ে তাহাদের কোন ধারণা এবং প্রস্তুতি নেই তাই তারা কোন প্রকার জবাব দিতে পারবে না এবং মুক্তিও পাবে না। 

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে পরকাল থাক বা না থাক উভয় অবস্থাতেই বিশ্বাসীদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকছেনা আর অবিশ্বাসীদের ধারণা যদি সত্য হয় তাহলেই কেবল তারা বিপদমুক্ত থাকবে না হয় তাদের সমূহ বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বলা যায় যে অবিশ্বাসীদের ধারণাটি মোটেও নিরাপদ নয় বরং বিপদ জনক। ‘সাবধানতা’ এ ধারণাটিকে কখনও অনুমোদন করে না। অর্থাৎ একজন সাবধান এবং চিন্তাশীল ব্যক্তি এ ধারণাটি পোষণ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে সাবধানতা যে পথকে সমর্থন করে সে পথে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি ?

দ্বিতীয় পর্বের লিংক 

তৃতীয় পর্বের লিংক


লেখকঃ

মু. মেজবাহ উদ্দিন

সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, 

সীতাকুণ্ড কলেজ, চট্টগ্রাম।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ