Ticker

6/recent/ticker-posts

পরকাল দর্শন - পরকাল বলে কিছু আছে কি? (পর্ব ২)



পরকাল-কি-আছে

পরকাল দর্শন - পরকাল বলে কিছু আছে কি? (পর্ব ২) 


প্রথম পর্বের লিংক 

পরকালের অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করেন তারা তাদের ধারণা বা মতের সমর্থনে সাধারণত দু'টি যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন।

তাদের প্রথম যুক্তি হলঃ 

পরকালের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষণলব্ধ বা ইন্দ্রিয়লব্ধ কোন জ্ঞান পাওয়া যায় না। চিন্তা বা বুদ্ধির সাহায্যেও এর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং যার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই তার অস্তিত্ব আছে এ কথা মনে করারও কোন কারণ নেই। আর যারা পরকালের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তাদের কাছেও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই। পরকাল সম্পর্কীয় তাদের ধারণা শুধুই মনের ধারণা বা কল্পনা মাত্র।

তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হলঃ 

মানুষের মৃত্যুর পর মৃতদেহ মাটিতে পঁচে গলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। বিবর্তনের গতিশীল প্রক্রিয়ায় তা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক গ্যাস ও মৃত্তিকা হয়ে যাবে। মানব দেহের কোন চিহ্নই থাকবে না। সুতরাং যার কোন চিহ্নই থাকবে না তার পক্ষে পুনরায় জীবন লাভ করা কি ভাবে সম্ভব ?

পরকালে অবিশ্বাসীদের ধারণা বিশেষভাবে এ দু’টি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা এ দুটি যুক্তির ভিত্তিকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। 

তাদের প্রথম যুক্তির দুর্বলতা হল তারা আছে বলে প্রমাণ করতে না পারাটাকে ‘নাই’ এর প্রমাণ হিসাবে ধরে নিয়েছেন। কোন বস্তু আছে বলে প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ‘নাই বলে প্রমাণিত হয়েছে’এরূপ ধরে নেওয়া সবসময় যুক্তিসংগত নয়। আছে বলে প্রমাণ করা আর নাই বলে প্রমাণ করা এক কথা নয়। আছে বলে প্রমাণ করার চেয়ে নাই বলে প্রমাণ করা অনেক কঠিন। ‘পুকুরে মাছ আছে’- এ বাক্যটি প্রমাণ করার জন্য পুকুরের যে কোথাও একটি পুঁটি কিংবা মলা মাছ দৃষ্টিগোচর হওয়াটাই যথেষ্ট। 

কিন্তু ‘পুকুরে মাছ নেই’- এ বাক্যটি প্রমাণ করার জন্য পুকুরের প্রতি ইঞ্চি জায়গাতেই ‘মাছ নেই’ বলে প্রমাণ করতে হবে যা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যারা পরকালের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী তারা কি সৃষ্টিজগতের সর্বত্র এভাবে বিচরণ বা অনুসন্ধান করে এসে তারপর পরকাল নেই বলে নিশ্চিত হয়েছেন ?

পরকালে অবিশ্বাসীদের এ যুক্তিটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রসূতও নয়। কারণ বিজ্ঞানীরা কখনো কোন বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে না পারলে তা নেই এরূপ বলেন না, বরং বিনয়ের সাথে এতটুকু বলেন যে, ‘বস্তুটি আছে কি নেই তা আমরা নিশ্চিত নই’। যেমন- বিশ বৎসর আগে সৌরজগতের গ্রহ সংখ্যা যা ছিল এখন তার চেয়ে বেশী। ইতোমধ্যে যেসব গ্রহ আবিস্কৃত হয়েছে সেগুলোর অস্তিত্বের কোন প্রমাণই তখন বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। যেগুলোর অস্তিত্বের কোন প্রমাণ তখন ছিল না সেগুলো নেই বলে ধরে নিলে ধারণাটি কি ভুল বলে প্রমাণিত হতো না ? 

Bohubrihi-Online-Course


কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১৪৯২ সালে। এর আগে আমেরিকার অস্তিত্বের কোন প্রমাণই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল না। তাই বলে কি আমেরিকা তখন ছিল না এ কথা বলা যাবে? বস্তুত পক্ষে জ্ঞানের বিষয়বস্তু জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের জানা বা না জানার সাথে বস্তুর অস্তিত্বের কোন সম্পর্ক নেই। কোন বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানলাম মানে বস্তুটির সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হলাম। কাজেই কোন বস্তুর সাথে আমাদের পরিচয় না ঘটলে বস্তুটি নেই এরূপ মনে করার কোন সুযোগ নেই। 

পরকালে অবিশ্বাসীদের দ্বিতীয় যুক্তিটি হল- মানুষের মৃতদেহ মাটিতে পঁচে গলে মিশে যাবার পর ঐ দেহের পক্ষে পুনরায় জীবন লাভ করা সম্ভব নয়।

অবিশ্বাসীদের এ ধারণার উৎপত্তির কারণ সম্ভবত মাটিতে মিশে যাওয়া মানব দেহ কিভাবে পুনরায় জীবন লাভ করবে ?- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়া। অর্থাৎ মিশে যাওয়া মানুষটির পুন:জীবন লাভ কিভাবে সম্ভব হবে ? - এ প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকার কারণে এ কাজটিকে তারা অসম্ভব বলে ধরে নিয়েছেন।

আমার মনে হয় তারা এ কাজটির দায়িত্ব পৃথিবীর কোন রাজা বাদশার উপর অর্পন করে তারপর চিন্তা করেছেন বলে তাদের মধ্যে এই  ‘অসম্ভব’ এর ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। আসলে এ কাজতো পৃথিবীর কোন রাজা বাদশার নয়। পৃথিবীর রাজা বাদশারা পৃথিবী নামক রাজ্যটিকে ‘মগের মুল্লুুক’-এ পরিণত করেছে বলেইত পরকালের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। মানুষের ইহকালীন জীবনের কৃত কর্মের ফল প্রদানের জন্য, যত অত্যাচারিত নির্যাতিত আছে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার ‘ন্যায় বিচার’ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য তথা ন্যায়ের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য পরকালের আবশ্যকতা। আর এ কাজ মানুষের সীমাবদ্ধ শক্তি দ্বারা কখনো সম্ভব নয় বিধায় এ কাজ পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান পরাক্রমশালী আল্লাহতাআলার উপরই অর্পিত। তিনিই সকল মানুষকে তাদের কৃতকর্মের ফল পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য পুনরায় জীবন দান করবেন। তাঁহার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি সেই সত্ত্বা যিনি আমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করাও তাঁর পক্ষে মোটেও অসম্ভব নয়। কারণ প্রথম সৃষ্টির চেয়ে দ্বিতীয় সৃষ্টি কখনো কঠিন হতে পারে না।

Home-devices
Smart Home Devices from BD-Shop

মহান স্রষ্টার অসীম সৃষ্টি ক্ষমতাকে বুঝতে হলে চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে। বিজ্ঞানের নিয়ম বা সূত্রগুলোর আওতায় এনে স্রষ্টার সীমাহীন সৃষ্টি ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ তিনি প্রকৃতি জগতের সব নিয়মগুলোর স্রষ্টা, কিন্তু নিজে কোন নিয়মের অধীন নন। কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা তাঁকে আবদ্ধ করতে পারে না। আমরা রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সাহায্যে যখন তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করতে যাই তখন তাঁর পক্ষে যে ‘সবই সম্ভব’ তা আর বুঝে উঠতে পারি না। বহু সম্ভব বিষয়কেই তখন আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতাকে আমরা তখন ৭/৮ টি প্রাাকৃতিক নিয়মের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি। অথচ তিনি যে এসব নিয়মের স্রষ্টা এবং এগুলোকে ভেঙ্গে তিনি যে তদস্থলে অন্য নিয়ম সৃষ্টি করতে পারেন আবার এসব নিয়মের বাইরে বিশ্বজগতের আরো হাজার হাজার নিয়মের তিনিই যে স্রষ্টা এ কথা আমরা ভুলেই যাই।

মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপনার প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালে তাঁর অসীম সৃষ্টিক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। তবে তাঁর এ ক্ষমতার সীমা কতটুকু তা নির্ণয় করার চেষ্টা মানব জ্ঞানাতীত। মানুষ হিসাবে আমরা শুধু মাত্র এটুকু বলতে পারি যে তিনি সবই করতে সক্ষম এবং আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব।

High-speed-router
High Speed Router

কিছু মানুষ আছেন যারা জগতের সব কিছুকেই বৈজ্ঞানিক সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান। পুনরায় মানব সৃষ্টির পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া কিরূপ হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরও তারা বৈজ্ঞানিক চশমার ভিতর দিয়েই অন্বেষণ করেন। এসব মানুষের বোধশক্তিকে কিছুটা তুষ্ট করার জন্য আমি এবার  বিজ্ঞান এবং প্রচলিত সৃষ্টি পদ্ধতিগুলো থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করব।

যেমন - আমরা প্রথমবার সৃষ্ট হয়েছি কিভাবে তা একটু লক্ষ্য করুন। একটি শুক্রকীট এবং একটি ডিম্বকোষ থেকে। এদের সংযোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন জীবন ছিল না। এই মৃত, তুচ্ছ এবং অনুলে­খযোগ্য বস্তু থেকে আমাদের উৎপত্তি। এভাবেই মৃত থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়। তবে এটি প্রাণী সৃষ্টির একমাত্র পদ্ধতি বা মাধ্যম নয়। প্রাণীর জীন থেকেও প্রাণীর উৎপত্তি হতে পারে। ক্লোনিং এর উপর যে সব বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন তারা প্রাণীর জীন থেকে একইরূপ আর একটি প্রাণী উদ্ভাবন করেছেন। সিঙ্গাপুরের বিজ্ঞানীরা তাদের মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি বিলুপ্ত প্রাণীর কংকাল থেকে জীন নিয়ে সেই প্রাণীটি পুনরায় উদ্ভাবন করার আশা পোষণ করেছেন। 

মানব দেহ মাটিতে পঁচে গলে মিশে গেলেও তার জীন সুপ্ত অবস্থায় মাটিতে বিদ্যমান থাকবে। বস্তুর নিত্যতা নীতি অনুসারে বস্তুর কোন ধ্বংস নেই, পরিবর্তন আছে শুধু। কাজেই চলমান বিবর্তন প্রক্রিয়ার কোন না কোন স্তরে তা বিদ্যমান থাকবে। এই মৃত, সুপ্ত জীন উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অতি সহজেই পুনজীবন লাভ করতে পারে আর এ পুনজীবন লাভ করা মানুষটি হবে হুবহু পূর্বের মানুষটির মতই। 

এ বিষয়টি প্রচলিত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায়। যেমনঃ একটি মুরগীর ডিম ভেঙ্গে ফেললে কিছু তরল পদার্থ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে মুরগীর বাচ্চার কোন চিহ্নই নেই। অথচ মাত্র ২১ দিনের ব্যবধানে তা থেকে একটি বাচ্চা চিক্ চিক্ করে বেরিয়ে আসে। একটি মিষ্টি কুমড়ার গাছ স্বরূপ লতাটিকে হাজার টুকরা করলেও তাতে মিষ্টি কুমড়ার কোন চিহ্নই পাওয়া যাবে না। অথচ তা থেকে মাত্র দেড়/দু’মাসের মধ্যে মিষ্টি কুমড়া বেরিয়ে আসে। 

একই ভাবে একটি কাঁঠাল গাছের ভিতরও কাঁঠালের কোন চিহ্নই পাবেন না। অথচ বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে তা থেকেই বড় বড় কাঁঠালগুলি আমাদের চোখের সামনেই বেরিয়ে আসে। কাজেই ডিম থেকে  বাচ্চা, বৃক্ষ থেকে ফল, শুকনো মৃত বীজ থেকে উদ্ভিদ যেভাবে বের হয়ে আসে ঠিক সেভাবেই তিনি সেদিন মাটির ভিতরে মিশে যাওয়া অবস্থা থেকে অবশ্যই আমাদেরকে পুনরায় বের করে আনতে সক্ষম হবেন এবং তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম।

তৃতীয় পর্বের লিংক 


লেখক

মু. মেজবাহ উদ্দিন।

সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ,

সীতাকুণ্ড কলেজ, 

সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ