
প্রাপ্তি
জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে উদাস নয়নে আকাশ পানে চেয়ে আছেন মিসেস রওশন আরা বেগম। আজকের তারিখটার কথা মনে হলেই চোখ ফেটে অশ্রুরা বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু তিনি কাঁদতে রাজী নন। কার জন্য কাঁদবেন ? যে সব ছেড়ে চলে গেছে তার জন্য? আর কতদিনইবা কাঁদা যায়?
পেছন ফিরে তাকালেন আফতাব সাহেবের দিকে। না, কোন সাড়া শব্দ
নেই। ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ারটা টেনে নিয়ে পাশে বসলেন। মনের কষ্টরাও আর চুপ থাকতে
পারলনা- বেরিয়ে এল শব্দের আকারেঃ
“ আর কতদিন একা একা কাঁদবো বলতে পারো ? তুমি কি করে এতটা
স্বার্থপর হলে? আজকের দিনটাতেও আমাকে একাই কাঁদতে হবে?
ওহ! তুমিতো জানই না আজকে কোনদিন। আজ ১০ ডিসেম্বর, তোমার
মেয়ের জন্মদিন। গত বছরও এই দিনটাকে কত ঘটা করে পালন করলাম, কত হই চই, কত আনন্দ...
আজ কেন এমন হল বলতে পারো? আমি বুঝতে পারিনা , কাকে দোষারোপ
করব। একবার ভাবি, সব দোষ তোমার মেয়ের- চলে যাওয়ার আগে সে আমাদের কথা একবারও
ভাবলনা? কিভাবে পারলো ও?
কত শখ করে নাম রেখেছিলাম ‘শিখা’। ভেবেছিলাম অগ্নিশিখার মত
উজ্জ্বল হবে ওর জীবন। কিন্তু সে শিখা আমাদের সংসারটাকেই জ্বালিয়ে দেবে- ভাবিনি
কখনো।
ওয় কোন ইচ্ছাটা অপূর্ণ রেখেছি বলতো? আসলে দোষ তোমারই। তোমার
আহ্লাদই মেয়েকে বিগড়ে দিয়েছে। শাসন তো করতে দাও নি কখনো... “
আনমনা হয়ে বলেই চললেন মিসেস রওশন। প্রতিউত্তরের কোন আশা
নেই। কেননা আফতাব সাহেব লাইফ সাপোর্টে আছেন গত এক সপ্তাহ যাবৎ। তার অনুযোগ শুনছেন
কিনা তাও জানা নেই। তবুও বলে চললেনঃ
“ জানো, মিসেস রায়হান কি বলেছিলেন? বলেছিলেন – ‘ ভাবী,
আপনার মেয়েকে কেবল উচ্চশিক্ষিত করেছেন, বিলাসবহুল জীবন দিয়েছেন, কিন্তু মানুষ করতে
পারেননি। যখন যা চেয়েছে তখন তাই দিয়েছেন। আপনারাই শিখিয়েছেন দুনিয়ার কোন কিছুকে
তোয়াক্কা না করে কেবল নিজের কথা ভাবতে। সাফল্যের সংজ্ঞা শেখাতেও ভুল করেছেন।
প্রকারান্তে আপনারাই বলেছেন, যা চাও তা যেকোন মূল্যে নিজের করে নিতে শেখো, তাহলেই
সুখী হবে। আর শিখা তো সেই সুখ খুঁজতেই আপনাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাও আবার নিজের
বিয়ের দিন।
ভাবী, আমি আপনাকে আগেও বুঝানোর চেষ্টা করেছি, সবসময় ওর জেদ
এবং উশৃংখল চলাফেরাকে প্রশ্রয় না দিতে। যা চাই-তাই পাওয়াটাই সুখ নয়- এটা বোঝাতে
বলেছি। এ দুনিয়াতো পরীক্ষার স্থান মাত্র। আসল সুখ তো জান্নাতে। আর সে জান্নাত
মায়ের পায়ের নিচে, বাবার সন্তুষ্টিতে। একথাগুলো যদি ওকে শেখাতেন... ‘
মিসেস রায়হানের কথাগুলো না একেবারে ফেলে দিতে পারিনি।
নিজেকে শুধু ব্যর্থই মনে হচ্ছে। একটামাত্র মেয়ে, তাকেও বুঝি মানুষ করতে পারলামনা ...“
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরাশ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে একবার চেয়ে
বাইরে চলে গেলেন মিসেস রওশন।
আফতাব সাহেবের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা অশ্রু; অক্সিজেন
মাস্কটাও গোলাটে হয়ে এল।
-----------------------------------------------------------------
শিখার মনটা খুবই খারাপ। দ্বীপও ঘরে নেই, এক সপ্তাহ পর আজ অফিসে গেল। বিয়ের পর থেকে ও বাসায়ই ছিল- তাও শিখাকে কত কথা শুনতে হয়েছে! না জানি – আজ কি হয়! অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মনটা ।
“ এত এত আত্মীয়-স্বজন থাকে কারো? প্রতিদিন দল বেঁধে আসে নতুন বউ দেখতে, আর খোঁচা দিয়ে একেকটা কথা শুনিয়ে যায়। মিডল ক্লাস ফ্যামিলির এই সমস্যা- সব কিছু নিয়ে সবার মাথাব্যাথা। প্রাইভেসি বলতে কিছুই নেই। দ্বিপটাও না কেমন যেন হয়ে গেছে! আগে কত্ত কেয়ারিং ছিল- ওর সামনে শিখাকে কেও কিছু বলার সাহসই পেত না। আর এখন কতজন কত কথাই তো শোনাচ্ছে। কেও বলছে-“মা-বাবাকে এত সহজে ভুলে গেলে?” কেউবা জিজ্ঞেস করছে- “ আমাদের সহজ-সরল ছেলেটাকে কিভাবে ফাঁদে ফেললে?” কেউতো আবার শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে “ আমার মেয়েটাকে বাপু তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিব, বেশি পড়াতে গেলে একদিন মা-বাপকেই ভুলে যাবে!” আরো কত কি।
আর দ্বীপ? আত্মীয়- স্বজনের মন রক্ষার্থে কেবল চুপচাপ শুনেই যায়। আমি জিজ্ঞেস করলেই সাফ কথা – নতুন একটা সম্পর্কের জন্য এতগুলো পুরনো সম্পর্ক ভাঙতে পারবেনা। অথচ আমি তো ওর জন্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছি। বিয়েবাড়ির এত মানুষের সামনে মা-বাবার মাথা হেট হবে, সেটা পর্যন্ত ভাবিনি! তাহলে কি আমিই ভুল করলাম?”
ভাবতে ভাবতে শিখা রান্না ঘরের দিকে গেল-দ্বীপের মায়ের কাছে। মা’র কথা খুব মনে পড়ছে। অনেক আশা নিয়ে বললঃ
-“মা, আমি জানি আপনি আমার উপর রাগ করে আছেন, তাই কথা বলছেন না। কিন্তু আমিও তো আপনার সন্তানের মত ...“
-“ দেখো শিখা! এই ‘মা’ এবং ‘সন্তান’ শব্দদুটোর অর্থ তুমি হয়তো সেদিন বুঝতে পারবে যেদিন তুমি মা হবে। জীবনের কোন এক পর্যায়ে এটাও হয়তো বুঝবে সন্তানের দেওয়া আঘাত কতটা গভীর আর অসহনীয়। আমি তোমাকে মন থেকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু তোমার মুখে ‘মা’ ডাক শুনলেই তোমার অসহায় মায়ের কথা মনে পড়ে। অন্তরের গহীন থেকে কে যেন বারবার বলে উঠে -’ এমন স্বার্থপর সন্তানের মা হওয়ার চেয়ে নিঃসন্তান হওয়াই ভাল।‘ পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আর যদি পারো তাহলে তোমার মা বাবার কাছে মাফ চেয়ে নিও। কারণ মা- বাবার দোআ ছাড়া সন্তান সুখী হতে পারে না।“
‘স্বার্থপর! নিঃসন্তান! সুখী!’
-শব্দগুলোর অবিরাম প্রতিধ্বনি মনকে অশান্ত করে তুলছে। আর ভাবতে পারছেনা শিখা। বুকের মধ্যে কষ্টেরা জড়ো হয়ে ভারী পাথরের রূপ নিচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মস্তিষ্ক কেবল প্রাপ্তি আর ক্ষতির হিসাব মেলাচ্ছে। আর সেখানে বড় বড় ক্ষতিগুলোর ভীড়ে ছোট ছোট প্রাপ্তিরা হারিয়ে যাচ্ছে । নিজেকে আজ খুবই একা-অসহায় মনে হচ্ছে। মন উঁকিঝুকি দিয়ে সুখ খোঁজার চেষ্টা করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কারো ভারী দীর্ঘশ্বাস সুখগুলিকে গ্রাস করে নিতে চাইছে...
অনুতাপে বিদগ্ধ হৃদয় আজ প্রতীক্ষারতঃ
কেউ পেছন থেকে আসবে, মাথায় হাত রাখবে আর বলবেঃ
“কষ্ট পাসনে মা! তোর বাবা তো আছে ...”
-- সমাপ্ত--
0 মন্তব্যসমূহ
Feel free to comment for any query!